একজন মর্জিনা

মুক্তির চেতনা (মার্চ ২০১২)

মিষ্টি
  • ১৬
  • ৩৫
রাত প্রায় ১০ টা ।মর্জিনার কিছুতেই ঘুম আসছেনা । বিছানাই শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। মর্জিনার স্বামী আয়েনউদ্দিন এখনও বাড়ি ফেরেনি। তার একটু ভয় ভয় করছে। পুরা বাড়িতে সে একা। বারান্দায় যেতেও ভয় পাচ্ছে। এখন গন্ডগোলের সময়। দেশে যুদ্ধ চলছে। তাকে এরকমভাবে একা ফেলে আয়েনউদ্দিন কোথায় গেল সে ভেবে পাচ্ছে না।

মর্জিনার বয়স ১৮। সে মফস্বলের মেয়ে। কলেজে পড়তো। বাবা-মা ও ভাইকে নিয়ে ভালই ছিল। স্বপ্ন ছিল ইন্টার পাশ করার পর ভাই এর মতো ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করবে। কিন্তু হঠাৎ করে ১ মাস আগে আয়েনউদ্দিন এর সাথে তার বিয়ে দেয়া হয়। দেশে যুদ্ধ চলছে। ভাইয়ের কোন খবর নেই। শোনা গেছে ভাইয়া নাকি মুক্তিযুদ্ধে গেছে। এই সময়ে যুবতী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়া মা-বাবা নিরাপদ মনে করলেন। তাছাড়া আয়েনউদ্দিন পাত্র হিসেবে ভালো। বয়স যদিও একটু বেশী কিন্তু ভালো টাকা –পয়সা আছে।

প্রায় ভোর হয়ে আসছে। মর্জিনা দিশেহারা হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে শহরে মিলিটারি এসেছে। এর মধ্যে আয়েনউদ্দিন কোথায় গেল? অজানা আশঙ্কায় মর্জিনার বুক কেঁপে উঠছে । হন্তদন্ত হয়ে আয়েনউদ্দিন ঘরে ঢুকল। মর্জিনা তাকে জিজ্ঞেস করলো “আপনি কোথায় ছিলেন সারা রাত?” আয়েনউদ্দিন বলল বউ আমি সারা রাত মেজর সাহেবের ওখানে ছিলাম। উনি থাকতে বললেন। আমি চইলা আসি ক্যামনে? মর্জিনার বুক
কেঁপে উঠল,এ সব আপনি কি বলছেন? আপনি মিলিটারিদের ওখানে ছিলেন? যদি আপনারে গুলি করত ? আয়েনউদ্দিন হেসে উঠে বলল “বউ আমি তো শান্তি কমিটিতে যোগ দিছি। এখন আর কোন ভয় নাই। কেউ আমারে গুলি করবো না। উল্টা মাসে মাসে বেতন পামু”।

মর্জিনা এখন সারা দিন বাসায় একা থাকে । আয়েনউদ্দিন সকালে যায়, রাতে ফেরে। মাঝে মাঝে রাতেও ফেরে না।

রাত প্রায় ৩টা। মর্জিনা বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। এমন সমায় একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ পাওয়া গেল। একটু পরে আয়েনউদ্দিনের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল ”বউ দরজা খোল”। মর্জিয়ান দ্রুত দরজা খুলে দিল । আয়েনউদ্দিন এর সাথে আরও কিছু লোক আছে। একজন লোক কে বারান্দার রেলিং এর সাথে বাঁধছে। মর্জিনা অবাক হয়ে বলল “এই লোক কে?” আয়েনউদ্দিন বলল,বউ আইজকা একটা মুক্তি ধরছি। এই ব্যাটার পায়ে জখম আছে তাই ভাগতে পারে নাই। কালকে মেজর সাহেব এর কাছে নিয়া যামু। মর্জিনা অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকাল। পরদিন সকালে একজন এসে আয়েনউদ্দিকে খবর দিল “মেজর সাহেব পাশের গ্রামে গেছে। ২-৩ দিন পর আসবে। আয়েনউদ্দিন তখন মুক্তিযোদ্ধাটিকে তার বাড়িতে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। একবার তাকে মেজর সাহেবের হাতে তুলে দিতে পারলে নিশ্চয়ই তাকে অনেক পুরস্কার দেওয়া হবে।

মর্জিনা একটু ভাত আর পানি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাটির কাছে গেল। তাকে বলল “একটু ভাত খান”।কাইল রাতে থেকে তো কিছু খান নাই। ছেলেটি তীব্র দৃষ্টিতে মর্জিনার দিকে তাকিয়ে বলল”আমার বাঁধনটা খুলে দেন । না হলে আমি খাব কি করে? মর্জিনা একটু হন্তদন্ত হয়ে শেষমেশ বাঁধনটা খুলেই দিল। লোকটা এখন বাবু হয়ে বসে ভাত খাচ্ছে। মর্জিনা পাশে বসে তার খাওয়া দেখছে। লোকটি অবিকল তার ভাইয়ের মতো করে খাচ্ছে। ভাই ঢাকা থেকে বাড়ি আসলে এভাবে বাবু হয়ে বসে কপকপ করে ভাত খেত। লোকটিকে মর্জিনা জিজ্ঞেস করলো ভাই আপনার নাম কী ? লোকটি বলল,”কয়দিন পরতো আমাকে মেরেই ফেলবে । কী হবে নাম দিয়ে ? ” মর্জিনা চমকে উঠলো । কত সহজেই না লোকটা নিজের মৃত্যুর কথা বলছে ! মর্জিনা বলল , ভাই উনি বাড়ি আসলে আমি বলবো আপনারে ছেড়ে দিতে । মর্জিনা কে অবাক করে দিয়ে লোকটা শব্দ করে হেসে ফেললো । মর্জিনা বলল , আপনে হাসেন কেন ? আপনের ভয় করতেছে না ? লোকটা মুখটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল । সে বলল , আমিতো মানুষ , তাই আমারও ভয় হয় । কিন্তু মরার জন্যই তো এই রাস্তায় এসেছি । ভাগ্য ভাল হলে মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাব । না হয় মরতে হবে । মর্জিনা লোকটার কথা ভালভাবে বুঝতে পারলো না । তবে লোকটা যে মরার জন্য তৈরি এইটা সে বুঝতে পারলো ।

আয়েনউদ্দিন বাড়ি আসতেই মর্জিনা তাকে বলল , আপনে মুক্তি ছেলেটাকে মেজর সাহেবের কাছে নিয়া যাইয়েন না । আমি উনারে ভাই ডাকছি । মেজর সাহেব নাকি উনারে মাইরা ফালাইব । আয়েনউদ্দিন বলল , এইটা তুমি কি কয় , তুমি কোন সাহসে ঐ লোকরে ভাই ডাকছো ? মুক্তি হইল গিয়া দেশের শুত্রু । ওদের তো মাইরা ফেলানই উচিৎ । মর্জিনার বুকের ভেতরে ধ্বক করে একটা ধাক্কা লাগলো । তার ভাইও তো মুক্তি হইছে । কিন্তু তার ভাইতো দেশের শত্রু হতে পারে না । সে রাতে ভাইয়ের কথা মনে করে মর্জিনা খুব কাঁদল ।

মর্জিনা বুঝতে পারছে না সে কি করবে । আয়েনউদ্দিন বলে গেছে কালকে সকালে মেজরসাহেব আসবে । সে তো লোকটাকে মরতে দিতে পারবে না । কিন্তু সে লোকটাকে কিভাবে বাঁচাবে ?
রাত প্রায় ১২ টা । আয়েনউদ্দিন আঘোরে ঘুমাচ্ছে। মর্জিনা আস্তে আস্তে মুক্তিযোদ্ধা লোকটিকে বলল,ভাই আপনের পা এর খবর কী? হাঁটতে পারবেন। লোকটি বলল, হাঁটতে পারলে কী লাভ হবে ? মর্জিনা বলল, ভাই আপানের মতোই আমার একজন বড় ভাই আছে । সেও মুক্তি হইছে। আমি আপনারে মরতে দিতে পারমু না। পানি চইলা যান।

মর্জিনাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে গত রােত মুক্তিযোদ্ধাটা লোকটিকে ছেড়ে দিয়েছে। আয়েনউদ্দিন প্রচন্ড রাগে থর থর করে কাঁপছে আর মর্জিনা কে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে। এখন মেজর সাহেব মর্জিনা কে নিয়ে যাবে। তারপর তাকে কঠিন শাস্তি দিবে।

মর্জিনাকে জিপে তোলা হয়েছে। পাকিস্তানি মেজর লুলপ দৃষ্টিতে মর্জিনার দিকে তাকিয়ে আছে।আয়েনউদ্দিনের জন্য কেউ একজন সমবেদনা জানাতেই সে চেঁচিয়ে উঠল, “আমার কোন আফসোস নাই। ঐ বেটি মুক্তিটারে ছেড়ে দিছে। ওর শাস্তি হওয়া প্রয়োজন,কঠিন শাস্তি।”

জিপ ছেড়ে দিয়েছে। মর্জিনা শেষ বারের মতো আয়েনউদ্দিনের দিকে তাকাল। কি তীব্র সেই দৃষ্টি। আয়েনউদ্দিন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। মর্জিনা চুপচাপ বসে আছে । তাকে মনে হয় মেরে ফেলবে। তাতে কি? তার ভাইরা তো বেঁচে আছে। কিন্তু আফসোস তার ভাইয়ের সাথে কোন দিন দেখা হবে না। মর্জিনার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগলো।



আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াছিম অসাধারন ভাই
মামুন ম. আজিজ একজন মর্জিনাও স্বার্থক মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরূপ। েবশ কাহিনী।
মারুফ মুস্তাফা আযাদ রবিবাবুর সাথে গলা মিলিয়ে বলতে হচ্ছে, "ছোট প্রান ছোট কথা/ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা/ নিতান্ত সহজ সরল......... অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হইয়াও হইলনা শেষ।। পুরোটা লিখলাম না, বুঝে নিয়েন।
মাহবুব খান অনেক ভালো /৫ দিলাম
সালেহ মাহমুদ অসাধারণ গল্প, খুব ভালো লাগলো ভাই। ৫ এর বেশী থাকলে তাই-ই দিতাম। ধন্যবাদ।
আসন্ন আশফাক ".......পানি চইলা যান।" আর "মর্জিনাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। ................" এর মাঝে আলাদা করা যায়নি, এরকম ছোট ছোট ব্যাপার গুলো খেয়াল করলে আরো ভালো হত.
মিষ্টি আমার গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ সবাইকে ।
আহমেদ সাবের গল্পের কাহিনী ও উপস্থাপনা মুগ্ধ করল। এমন চমৎকার গল্পটা আরও পাঠক পাবার দাবী রাখে।
Abu Umar Saifullah অনেক সুন্দর

০৭ সেপ্টেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪